সবুজ আহম্মেদ। যিনি বর্তমানে সিলেট ক্যাডেট কলেজে প্রভাষক হিসেবে কর্মরত আছেন। ৩৭তম বিসিএস-এর সাধারণ শিক্ষা সুপারিশপ্রাপ্ত। যার মেধাক্রম ৬। তিনি ছিলেন একজন গার্মেন্টস কর্মী। কিন্তু নিজের উপর বিশ্বাস, অধ্যবসায় এবং স্বপ্ন ও কঠোর পরিশ্রমের কারণে একজন বিসিএস ক্যাডার।
এই মানুষটির গল্প তাঁর নিজের মুখ থেকেই শুনে আসি চলুনঃ যারা ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে পড়ে হতাশ এবং মনে করেন কোটা না থাকলে বিসিএস হয়না তাদের অনুপ্রেরণার জন্য আমার জীবনের সত্যটুকু লিখছি। গল্প নয় ; সত্যি । ২০০৮ সালে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এইচ এস সি পরীক্ষা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং এ যাওয়ার অনেক চেষ্টা করেও পারিবারিক কারণে যেতে পারিনি।
এর কারণ যতটা না দরিদ্রতা ছিল তার চেয়ে বেশি ছিল পরিবারে বিরাজমান অন্য একটি সমস্যা( একান্ত পারিবারিক তাই বলছিনা) । অনেক চেষ্টা করেও বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং করতে না পেরে আত্মহত্যা করব ভেবেছিলা্ম।কিন্তু সে সাহস না থাকায় রাগে দুঃখে ঢাকায় চলে আসি। এক আত্মীয়ের সহযোগিতায় একটি সোয়েটার গার্মেন্টস এ ঢোকার সুযোগ হয়। সেখানে ৪৫০০/- টাকা বেতনে চাকরি শুরু করি। ফ্যাক্টিরিটা ছিল টংগী চেরাগ আলীর বাদাম নামক স্থানে। আমি থাকতাম
চেরাগ আলীতে।চেরাগ আলীতে একটি টিনের বাসায় এক রুমে ৬জন ভাড়া থাকতাম। ভোরবেলা উঠে সিরিয়াল দিয়ে গোসল সেরে, খাবার খেয়ে, দুপুরের খাবার টিফিন ক্যারিয়ারে নিয়ে ছুটতাম অফিসে। ৮ টায় অফিস ,এক মিনিট লেট হলেই প্রবলেম। ৩ দিন লেট হলে একদিনের বেতন কাটা , সাথে হাজিরা বোনাস ৩০০( মাসে একদিন ও অফিস না করলে দেয়) কাটা । অফিস চলত সন্ধ্যা ৬টা অব্দি,কোনো কোনোদিন রাত ১০টা ।
রাতে অফিস থেকে ফিরে আবার পরের দিনের প্রস্তুতি। এভাবেই কাটে ১০টি মাস । একদিন এক বন্ধুর ( সোহেল রানা) সাথে কথা বলে জানতে পারলাম সে অনার্সে ভর্তি হয়েছে।তাদের আর্থিক স্বচ্ছলতা আমাদের তুলনায় অনেক খারাপ।তবু সে অনার্স করছে ; আর আমি গার্মেন্টস এ ! খুব সাধ জাগল। হাতে কিছু টাকাও জমিয়েছিলাম । চাকরিটা ছেড়েই দিলাম । চলে এলাম সেই বন্ধুর কাছে। এখনকার মতো তখন অনলাইনে আবেদন করা যেতো না ।কলেজে গিয়ে ফরম কিনতে হতো। বন্ধু রানা ই আমার জন্য সব ব্যবস্থা করে। ফরম জমা দিলাম ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজের মতো মফস্বলের একটি কলেজে । লাইব্রেরীতে গেলাম ভর্তি গাইড কিনতে ।সময় শেষের পথে ছিল তাই গাইড যা বিক্রি হয়েছে বাকিগুলো ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে তারা।
অবশেষ অর্ডার দিয়ে বাসায় (ঠাকুরগাঁও শহর থেকে ৪০ কি মি দূরে) গেলাম । যখন ভর্তি গাইড পেলাম আর মাত্র সতের দিন বাকি ছিল পরীক্ষার। পরীক্ষা দিলাম। সাড়ে ৪ হাজারের মধ্যে মেধাক্রম ১৩। সব বিষয়ই পেলেও ১ম পছন্দ ছিল বাংলা। ভর্তি হয়ে শুরু করলাম টিউশানি। ১৮মাস পর ১ম বর্ষ ফাইনাল দিলাম। ডিপার্টমেন্ট এ ফার্স্ট হবার সাথে সাথে সারাদেশে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ম পাঁচজনে একজন হলাম। এক্সিম ব্যাংকের স্কলারশীপ হল বিভাগীয় প্রধান ড. আমির আলী আজাদ স্যারের কল্যাণে। স্যারের পরামর্শেই টি সি নিয়ে এলাম রংপুরের কারমাইকেল কলেজে।
একাডেমিক পড়ালেখার পাশাপাশি চলে চাকরির পড়ালেখা। অনার্স ফাইনাল ইয়ার পরীক্ষায় ও একইরকম ফল করে চলে এলাম ঢাকায়।এম এ ভর্তি হলাম ঢাকা কলেজে, ঢাকা ইউনিভার্সিটির আন্ডারে আমরাই প্রথম ব্যাচ। কয়েকমাস পরেই ৩৭ বিসিএস প্রিলি। প্রিলির কয়েকদিন আগে কোরবানি ইদ। ইদে ঢাকাতেই থেকে গেলাম। প্রিলি দিলাম। কদিন পরেই বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এর একটি পরীক্ষা দিলাম। এদিকে প্রিলি হল ওদিকে বিমানের জব হল। ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জয়েন করলাম গ্রাউন্ড সার্ভিস এসিস্ট্যান্ট হিসেবে। এরই মধ্যে পরীক্ষা দিলাম
বাংলাদেশ ক্যাডেট কলেজে ,লেকচারার হিসেবে। ৩টি পোস্ট ছিল। জব হল। যেহেতু এই পদটি ৯ম গ্রেডের ছিল তাই বিমান ছেড়ে এখানে জয়েন করলাম। পোস্টিং সিলেট ক্যাডেট কলেজ। ক্যাডেট কলেজে জয়েনিং এর আগে ২ মাস সময় পেয়েছিলাম । বিমানের চাকরি ছেড়ে বিসিএস রিটেন পড়লাম। ১১০০ মার্ক্সের মধ্যে ৯০০ মার্কসের পরীক্ষা শেষ করে ক্যাডেট কলেজে জয়েন করলাম । এখান থেকেই ছুটি নিয়ে বিষয়ভিত্তিক ২০০ মার্কসের পরীক্ষা দিলাম। কদিন পরেই এম এ পরীক্ষা । সিলেট থেকে ১ দিনের ছুটি নিয়ে পরীক্ষা দিয়ে আসতাম। এম এ পরীক্ষা শেষ হবার কদিন পরই ৩৭ ভাইভা। ভাইভা দিলাম। যখন ভাইভা দিলাম তখনো এম এ রেজাল্ট হয়নি। ১ মে ২০১৮ অধিভুক্ত সাত কলেজের বাংলার এম এ রেজাল্ট হল।ফল আগের মতোই। প্রায় দুই বছর লাগল এম এ শেষ হতে। তার কয়েকদিন পরেই ১২ জুন ২০১৮ হল ৩৭ বিসিএস এর রেজাল্ট। আল্লাহর রহমতে শিক্ষা ক্যাডারে ৬ষ্ঠ স্থান অর্জন করলাম। (অনেক কথা ছিল , বড় হয়ে যাবে ,তাই আজ বললাম না।) আমি যদি এতো ঝামেলার মধ্যে থেকেও কোটা ছাড়া, জীবনের ১ম বারেই, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, মাস্টার্স হবার আগেই বিসিএস ভাইভা দিয়ে ক্যাডার হতে পারি তাহলে আপনি তো লক্ষবার পারার কথা। সুতরাং হতাশ হবেন না। লেগে থাকুন । সফলতা আসবেই ইনশাল্লাহ।