১। বর্তমান ভুমিকম্প একটি অতিপরিচিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ভূমিকম্পের ক্ষয়-ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তুমি কী ধরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করবে?
নির্দেশনাঃ
(ক) ভূমিকম্প কী লিখবে।
উত্তর:
ভূমিকম্প হচ্ছে ভূমির কম্পন। ভূ অভ্যন্তরে যখন একটি শিলা অন্য একটি শিলার উপরে উঠে আসে তখন ভূমি কম্পন হয়।
পৃথিবীপৃষ্ঠের অংশবিশেষের হঠাৎ অবস্থান পরিবর্তন বা আন্দোলনই ভূমিকম্পন। হঠাৎ যদি ঘরের কোনো জিনিস দুলতে শুরু করে—যেমন, দেয়ালঘড়ি, টাঙানো ছবি বা খাটসহ অন্য যেকোন আসবাব—বুঝতে হবে ভূমিকম্প হচ্ছে। সহজ কথায় পৃথিবীর কেঁপে ওঠাই ভূমিকম্প।
সারা পৃথিবীতে বছরে গড়ে ছয় হাজার ভূমিকম্প হয়। এগুলোর বেশিরভাগই মৃদু, যেগুলো আমরা টের পাই না।
সাধারণত তিন ধরনের ভূমিকম্প হয়ে থাকে—প্রচণ্ড, মাঝারি ও মৃদু। আবার উৎসের গভীরতা অনুসারে ভূমিকম্পকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়—অগভীর, মধ্যবর্তী ও গভীর ভূমিকম্প।
ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ভূ-পৃষ্ঠের ৭০ কিলোমিটারের মধ্যে হলে অগভীর, ৭০ থেকে ৩০০ কিলোমিটারের মধ্যে হলে মধ্যবর্তী এবং ৩০০ কিলোমিটারের নিচে হলে তাকে গভীর ভূমিকম্প হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
(খ) ভূমিকম্পে কী ধরণের ক্ষয়-ক্ষতি হয় তা উল্লেখসহ ক্ষয়-ক্ষতি রােধে কী কী করণীয় লিখবে।
উত্তর:
ভূমিকম্পের পূর্বাভাস বা প্রেডিকশন খুবই জটিল। আমরা কোনো নির্দিষ্ট ভূমিকম্পকে সরাসরি নির্ণয় করতে পারি না, কিন্তু মাইক্রোসিসমিসিটি গবেষণা, ফোকাল ম্যাকানিজম গবেষণার মাধ্যমে সম্ভাব্য পূর্বাভাস এবং ঝুঁকিপূর্ণ স্থান, হাইসিসমিসিটি, লোসিসমিসিটি নির্ণয় করতে পারি, যা জনসচেতনতা বৃদ্ধিসহ জীবন ও সম্পদের ক্ষয়-ক্ষতি রোধে অত্যন্ত সহায়ক। ভূমিকম্পবিষয়ক দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য সরকারের একটি সুস্পষ্ট কর্মপরিকল্পনা জরুরি প্রয়োজন।
সাধারণত ডাকটাল রক এলাকায় ভূকম্পন তুলনামূলক কম হয়ে থাকে এবং ব্রাইটাল রক ভূকম্পনের জন্য যথেষ্ট উপযোগী। যখন ভূ-অভ্যস্তরে ক্রাস্টাল ডিফরমেশন ঘটে, তখন সে স্থানে স্ট্রেস অ্যাকুমোলেশন হতে থাকে। যখন অ্যাকুমোলেশন বেশি মাত্রায় পৌঁছায়, তখনই আর্থকোয়েক বা ভূকম্পনের মাধ্যমে এনার্জি রিলিজ হয়ে থাকে। আর্থকোয়েক ফোকাল ম্যাকানিজম গবেষণা থেকে দেখা যায়,
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের দিকে কমপ্রিশন টেকটনিক স্ট্রেস লোডিং হচ্ছে, যা দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে মধ্যাঞ্চলের চেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। তা ছাড়া ট্রান্স এশিয়াটিক জোন, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, নেপাল, ভারত, হাইসিসমিসিটি জোন। ভারত ও মিয়ানমারের দিক থেকে চলে আসা ভূ-অন্তরিভাগ দুটোর সংযোগস্থলে সম্ভাব্য ফল্ট লাইনের প্রভাব এবং ওই লাইনের ভূগর্ভস্থ মাটির স্তর অধিকতর দুর্বল বলে রাঙামাটি পার্বত্য অঞ্চল দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মতো ঝুঁকিপূর্ণ। তা ছাড়া সিসমিসিটি গবেষণায় লক্ষ করা যায়,
বাংলাদেশের ভূ-অভ্যন্তরীণ ক্রাস্টের গঠন কম স্তরায়িত এবং সময়ের সাপেক্ষে সিসমিসিটির পরিবর্তন লক্ষণীয়। এ কথা সত্য যে, ভূ-অভ্যন্তরে সিসমিক প্রিকারছারের পরিবর্তন বুঝতে পারা অত্যন্ত জটিল ও সূক্ষ্ম। তবে এসব গবেষণা ইঙ্গিত করে সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ ভূকম্পনের।
করণীয়: ভূমিকম্পজনিত দুর্যোগ থেকে জীবন ও সম্পদ রক্ষার প্রয়োজনে সম্ভাব্য ভূমিকম্প মোকাবিলায় সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানকে নিচের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া একান্ত প্রয়োজন।
১. জনসচেতনতা বৃদ্ধি
২. ভূমিকম্প মোকাবিলায় পূর্বপ্রস্তুতি
৩. ভূমিকম্প-পরবর্তী উদ্ধার, ত্রাণ ও পুনর্গঠন কর্মসূচি ইত্যাদি
১. ভূমিকম্পে দালানকোঠার নিচে পড়ে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয়। সম্ভাব্য ভূমিকম্পের প্রস্তুতি ও ক্ষয়ক্ষতি প্রশমনে জনসচেতনতা বৃদ্ধি একান্ত প্রয়োজন। ভূমিকম্পে জনসাধারণের করণীয় সম্পর্কে যেমন: ভূমিকম্পের আগে, ভূমিকম্পের সময় ও পরে কী করা উচিত, সে বিষয়ে অবহিত করা। তা ছাড়া ভূমিকম্প কী, কেন হয় ও এর প্রভাব; পরিকল্পিতভাবে বাড়িঘর নির্মাণ না করলে, প্রয়োজনীয় বিল্ডিং কোড মেনে না চললে কী ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে, সে বিষয়ে সচেতন করা। নিচে ভূমিকম্পের আগে, পরে ও ভূ-কম্পনের সময় সাধারণের করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
ভূমিকম্পের আগে
(ক) বিদ্যুৎ ও গ্যাসলাইন বন্ধ করার নিয়মকানুন পরিবারের সবার জেনে রাখা।
(খ) ঘরের ওপরের তাকে ভারী জিনিসপত্র না রাখা, পরিবারের সব সদস্যের জন্য হেলমেট
রাখা।
(গ) পরিকল্পিত বাড়িঘর নির্মাণের জন্য বিল্ডিং কোড মেনে চলা। ভবনের উচ্চতা ও লোডের
হিসাব অনুযায়ী শক্ত ভিত দেওয়া, রেইন ফোর্সড কংক্রিট ব্যবহার, পাশের বাড়ি থেকে
নিরাপদ দূরত্বে বাড়ি নির্মাণ, গ্যাস ও বিদ্যুৎ লাইন নিরাপদভাবে স্থাপন করা। গর্ত ও নরম
মাটিতে ভবন নির্মাণ না করা।
ভূমিকম্প চলাকালে
(ক) নিজেকে ধীরস্থির ও শান্ত রাখা, বাড়ির বাইরে থাকলে ঘরে প্রবেশ না করা।
(খ) একতলা দালান হলে দৌড়ে বাইরে চলে যাওয়া। তা ছাড়া বহুতল দালানের ভেতরে
থাকলে টেবিল বা খাটের নিচে চলে যাওয়া ও কাচের জিনিসের কাছ থেকে দূরে থাকা।
লিফট ব্যবহার না করা।
(গ) উঁচু দালানের জানালা বা ছাদ থেকে লাফ দিয়ে নামার চেষ্টা না করা। ভূমি ধসে পড়ার
সম্ভাবনা আছে এমন উঁচু ভূমি থেকে দূরে থাকা।
(ঘ) ভূমিকম্পের সময় বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা।
ভূমিকম্পের পরে
(ক) ক্ষতিগ্রস্ত ভবন থেকে ধীরস্থির ও শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে বের হওয়া।
(খ) রেডিও টেলিভিশন থেকে জরুরি নির্দেশাবলি শোনা এবং তা মেনে চলা।
(গ) বিদ্যুৎ, গ্যাস, টেলিফোন লাইনে কোনো সমস্যা হয়েছে কি না, পরীক্ষা করে নেওয়া ও প্রয়োজনে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
(ঘ) সরকারি সংস্থাগুলোকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সহযোগিতা করা।
(ঙ) উদ্ধারকাজে নিজেকে নিয়োজিত করা। অস্থায়ী আশ্রয়স্থলে ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা। যোগাযোগব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সার্বিক সহযোগিতা করা।
২। ভূমিকম্প বিষয়ে সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানের পূর্বপ্রস্তুতি থাকা আবশ্যক। সে জন্য সম্ভাব্য ভূমিকম্প-পরবর্তী সময়ে সঠিকভাবে নিজেকে সেবায় মনোনিবেশ করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণসহ সব প্রতিষ্ঠানের যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। বর্তমান কাঠামোতে ভূমিকম্পবিষয়ক সার্বিক প্রস্তুতি অত্যন্ত নগণ্য বিধায় পূর্বপ্রস্তুতির উন্নয়ন একান্ত আবশ্যক।
৩। ভূমিকম্প-পরবর্তী উদ্ধার ও ত্রাণ কর্মসূচি নিশ্চিতকরণ। উদ্ধার কর্মসূচির অভাবে অসংখ্য প্রাণহানি ঘটে থাকে। পূর্বপ্রস্তুতি, দক্ষ প্রশিক্ষণ, উন্নত প্রযুক্তি, শক্তিশালী নেটওয়ার্ক উদ্ধার কর্মকাণ্ডের মূল চাবি। তা ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের জন্য প্রয়োজনীয় ত্রাণ/ওষুধ, চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করা। উল্লেখ্য, ভূমিকম্পের দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেমন ফায়ার ব্রিগেড, সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিমানবাহিনী, রেড ক্রিসেন্ট, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি চমৎকার সম্পর্ক থাকা জরুরি।
বাংলাদেশ প্লেট বাউন্ডারির অন্তর্ভুক্ত না হয়েও দুর্বল অবকাঠামো, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, প্রয়োজনীয় বিল্ডিং কোড মেনে না চলার কারণে এবং যত্রতত্র ভবন ও স্থাপনা নির্মাণের ফলে বাংলাদেশ বিশ্বের একটি অন্যতম ভূমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। যেহেতু ভূমিকম্প একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, একে থামিয়ে রাখা সম্ভব নয়। সেহেতু ভূমিকম্প পূর্বপ্রস্তুতি ও ক্ষয়ক্ষতি রোধে ভূমিকম্প-পরবর্তী শক্তিশালী এবং কার্যকর প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেই এই দুর্যোগ মোকাবিলা সম্ভব।